বঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারিকরণের উদ্যোগ নিতে চলেছে রাজ্য সরকার। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ বা পিপিপি মডেলে রাজ্যের শিক্ষাকে আরও উন্নত করতে রাজ্য সরকারের এই পরিকল্পনা বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও এই ইস্যুতে বিশেষজ্ঞরা মনে করেছেন, আদতে এই নীতি সার্বিক শিক্ষাকে শ্রীহীন করে দেবে।
শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী-শিক্ষানুরাগী ঐক্য মঞ্চের রাজ্য সম্পাদক কিংকর অধিকারী মনে করছেন, "রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থাকে পিপিপি মডেলের মাধ্যমে যেভাবে সম্পূর্ণ বেসরকারিকরণ করার ছক কষা হচ্ছে, তাতে শিক্ষা আরও মহার্ঘ পণ্যে পরিণত হবে। এবার থেকে সাধারণ বাড়ির সন্তানরা তার নাগাল পাবে না। কোনমতেই তা হতে দেওয়া চলে না।" তিনি আরও বলেন, "দীর্ঘদিন শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী নিয়োগ না-করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্রমশ মানুষের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করে তোলা হচ্ছে। নেই নৈশ প্রহরী, নেই ঝাড়ুদার। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতেও নেই পর্যাপ্ত শিক্ষক, নেই পরিকাঠামো, নেই গ্রুপ ডি, ক্লার্ক-এর পদে কর্মী। অর্থের বিনিময়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিতে যা রয়েছে, সরকারি স্কুলের পরিকাঠামোতে তা নেই।"
গত ২ডিসেম্বর নবান্নে এসে মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে একান্তে বৈঠক করে গিয়েছিলেন আদানি গ্রুপের প্রধান গৌতম আদানি। গৌতম আদানির পর গত ১০ফেব্রুয়ারি নবান্নে এসে মুখ্যমন্ত্রী ও মুখ্যসচিবের সঙ্গে বৈঠক করেন আদানি পুত্র করণ আদানি। জানা গেছে, মুখ্যমন্ত্রী ও মুখ্যসচিবের সঙ্গে একান্ত বৈঠকে তাজপুর গভীর সমুদ্র বন্দরের পাশাপাশি এরাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রে আদানি গোষ্ঠীর বিনিয়োগ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। ঘটনা হলো, ২০০৩সাল থেকে আদানি গোষ্ঠী শিক্ষাক্ষেত্রে প্রবেশ করে। ‘আদানি বিদ্যা মন্দির’ শিক্ষাক্ষেত্রে আদানি গোষ্ঠীর নয়া বিনিয়োগের ক্ষেত্র। আদানিদের হাতে রাজ্যের সরকারি শিক্ষাঙ্গনকে উন্মুক্ত করে দেওয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে রাজ্য।
ইতিমধ্যেই ৭৯টি জুনিয়ার হাই ও হাই স্কুলে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারণ হিসাবে পড়ুয়ার সংখ্যাকে সামনে এনেছিল সরকার। শিক্ষক, শিক্ষিকাদের বদলি করে দেওয়া হয়েছিল অন্য বিদ্যালয়ে।
খসড়া নীতিতে স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, রাজ্য সরকার বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের হাতে তুলে দেবে জমি, বাড়ি। বেসরকারি সংস্থাকে সরকারের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জমি ও বাড়ি তুলে দেওয়ার জন্য সময়ে সময়ে প্রস্তাব তৈরি করবে। যার মূল উদ্দেশ্য হিসাবে স্পষ্টতই বলে দেওয়া হয়েছে, বেসরকারি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। পিপিপি মডেলে স্কুল তৈরির জন্য সরকারের তরফে প্রস্তাব (রিকোয়েস্ট ফর প্রোপোজাল) আসার পর বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা তাতে অংশগ্রহণ করবে। কাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে সরকারি স্কুলের জমি ও বাড়ি তা ঠিক করার সময় বিনিয়োগে আগ্রহী সংস্থার শিক্ষাজগতে কাজের গুণগত মান ও আর্থিক ক্ষমতা বিচার করবে সরকার। ৮০শতাংশ প্রযুক্তিগত দিকের সঙ্গে ২০শতাংশ আর্থিক সক্ষমতা থাকলেই সরকারি সম্পত্তি তুলে দেওয়া হবে বেসরকারি হাতে।
নিয়োগের দুর্নীতিতে জর্জরিত হলেও এরাজ্যে এখনও শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্ব পালন করে স্কুল সার্ভিস কমিশন। কিন্তু ভবিষ্যতে শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্ব থেকেও হাত তুলে নেবে সরকার। খসড়া নীতিতে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, স্কুল চালাতে শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজের জন্য নিয়োগের দায়িত্ব পালন করবে বেসরকারি সংস্থাই। রাজ্যের চালু বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে এখনই নামমাত্র অর্থের বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ করার চল আছে। এরপর একদিকে যেমন সরকার শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্ব থেকে হাত গুটিয়ে নেবে, তেমনই সামান্য অর্থের বিনিময়ে শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের বাধ্য করা হবে শিক্ষাদানে। পিপিপি মডেলে স্কুলে কত শিক্ষক নিয়োগ হবে তার সংখ্যাও ঠিক করার দায়িত্ব বর্তানো হয়েছে বিনিয়োগকারীদের ওপরই।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন